বাংলাদেশ আওয়ামীলীগঃ
কিছু কিছু প্রত্যাবর্তন ইতিহাসে লেখা থাকে। কারো কারো ফিরে আসা মহাকালের নিয়মে ঘটে। কোনো কোনো ব্যক্তির উপস্থিতিই হয়ে ওঠে পুরো জাতির জাতীয় জাগরণের আলোকবর্তিকা। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এমনই একজন ব্যক্তিত্ব, যার প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথে ঝিমিয়ে পড়া বাঙালি জাতি অদম্য শক্তিতে জেগে ওঠে। হ্যাঁ, ১৯৮১ সালের ১৭ মে দিনটির কথা বলছি। প্রায় ছয় বছর নির্বাসন শেষে জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলার মাটিতে পা রাখেন এদিন, আজকের আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি রচিত হয়েছে ঠিক তখনই।
বঙ্গবন্ধু কন্যার এই স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমেই আবারো মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর স্বপ্ন ফিরে পেয়েছে স্বৈরাচার ও উগ্রবাদীদের ষড়যন্ত্রে ক্ষত-বিক্ষত বীর বাঙালি। তাই পরিবার হারানোর বেদনা বুকে চেপে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, শেখ হাসিনার স্বদেশে ফেরার এই অদম্য সাহসী দিনটিই বাঙালি জাতির লুট হয়ে যাওয়া স্বপ্ন ফিরে পাওয়ার দিন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বাস্তবায়ন করেছেন তিনি। শেখ হাসিনার অক্লান্ত পরিশ্রম এবং সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনাতেই বিশ্বের বুকে ডিজিটাল রাষ্ট্র হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ।
এর আগে- ১৯৭৫ সালরে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকরা যখন সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে, তখন তার দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ভাগ্যক্রমে প্রাণে বেঁচে যান। পরবর্তীতে ১৯৮১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনে শেখ হাসিনার অনুপস্থিতিতেই তাকে দলের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। জনদাবির মুখে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর গণমানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের ব্রত নিয়ে দেশে ফেরেন তিনি। ১৭ মে বিকালে শেখ হাসিনাকে বহন করা বিমানটি যখন বিমানবন্দরে অবতরণ করে, ততক্ষণে ঢাকা শহরের সড়কগুলো লোকারণ্য হয়ে ওঠে। উত্তাল মানব-ঢেউয়ের হৃদয়মথিত আনন্দঅশ্রুতে ভিজে ওঠে জ্যৈষ্ঠের তাপ ছড়ানো বিকালের প্রকৃতিও, তুমুল বর্ষণে ভিজে লাখো জনতার কণ্ঠে জয় বাংলা স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। শেখ হাসিনার উপস্থিতিতেই বদলে যায় দীর্ঘ ছয় বছরের অচলাবস্থার থমথমে পরিস্থিতি। তুমুল হর্ষধ্বনি তুলে নতুন করে দেশ গড়ে তোলার প্রত্যয় ব্যক্ত করে আপামর জনগণ।
শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং দেশ গড়ার প্রস্তুতি
১৯৮১ সালে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফিরেও পদে পদে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হয়েছে শেখ হাসিনাকে। মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছে একাধিকবার। কিন্তু হাল ছেড়ে দেননি তিনি। একদিকে স্বৈরশাসকদের কবল থেকে গণতন্ত্র রক্ষা, অন্যদিকে সারা দেশ ঘুরে গণমানুষের জীবনকে জানা- এই দুই মহাযজ্ঞের মধ্য দিয়েই ভবিষ্যতের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। যার ফলে আজকের বাংলাদেশকে বিশ্বের বুকে অনন্য উচ্চতায় প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। মনে ও মগজে বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রদর্শনকে আঁকড়ে ধরে এবং তা বাস্তবায়নের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা থেকে এই দুর্গম যাত্রপথ অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বৈরাচার ও উগ্রবাদের কড়াল গ্রাস থেকে মানুষকে মুক্ত করে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পথযাত্রা হিসেবে তিনটি বিশেষ ধাপ অতিক্রম করতে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। সেগুলো হলো: (১). বঙ্গবন্ধুর আদর্শ উপলব্ধি ও ধারণ করে তা বাস্তবায়নের সংগ্রাম। (২). জনগণের সাতটি মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য পরিকল্পনা ও অক্লান্ত শ্রমের মাধ্যমে বা বাস্তবায়ন করা। (৩). ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবনমান আধুনিক পৃথিবীর উপযোগী করে তোলার জন্য দেশকে প্রস্তুত করা।
দেশে ফেরার পরবর্তী সময়ে একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করা হয় শেখ হাসিনাকে। সেই সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা সম্পর্কে নিজের লেখা প্রবন্ধে শেখ হাসিনা জানান- আমি নিজেকে জিজ্ঞেস করতাম, ‘আমার বাবা শেখ মুজিব বেঁচে থাকলে এই পরিস্থিতিতে কী করতেন?’ প্রতিবারই আমি উত্তরে পেয়েছি- ‘বাংলাদেশের আদর্শের প্রতি অবিচল থাকতে হবে, যে আদর্শ আমার বাবাকে এবং পুরো জাতিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেই আদর্শের জন্য ৩০ লাখ মানুষ তাদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, সেই আদর্শের প্রতি আমাদের বিশ্বস্ত থাকা প্রয়োজন।’ পরিবার হারানোর শোককে শক্তিতে পরিণত করে নতুন প্রজন্মের জন্য একটি বসবাসযোগ্য দেশ গঠনের প্রতি মনোনিবেশ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ আজ ডিজিটাল রাষ্ট্র ও মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে।
জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতির ভাগ্য বদলের জন্য অদম্য সংগ্রাম
১৯৮১ সালে দেশে ফেরার পর থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত, দীর্ঘ ৯ বছর রাজপথে জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ হাসিনা। তার সাহসী নেতৃত্বের কারণে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। অবশেষে পতন হয় স্বৈরশাসকের। এরপর ১৯৯১ সালের নির্বাচনে অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী, বহুমাত্রিক ষড়যন্ত্রের কারণে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয় আওয়ামী লীগ। ১৯৯১ সালের সেই নির্বাচনের আগে দলের মধ্যে ভাঙন হলে এবং আওয়ামী লীগ একত্রিত থাকলে, সেবারও একচেটিয়াভাবে জয়লাভ করতো আওয়ামী লীগ।
ষড়যন্ত্রের কারণে সরকার গঠনে ব্যর্থ হলেও, প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে শক্ত ভূমিকা রাখেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনের জন্য রাজনৈতিক দলসহ সবাইকে সংগঠিত করেন তিনি। ফলে তার কারণেই দেশে ফিরে আসে সংসদীয় ব্যবস্থা। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে জনপ্রিয় ভোটে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সেবারই প্রথমবারের মতো দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তোলেন তিনি।
তবে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দুর্বার আন্দোলন থামিয়ে দিতে গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনাকে অজস্রবার রাষ্ট্রীয় মদতে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর সচিবালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালনকালে তাকে লক্ষ্য করে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এসময় কয়েকজন নিহত হন। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে তাকেসহ তার গাড়ি ক্রেন দিয়ে তুলে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিংয়ের সামনে শেখ হাসিনাকে লক্ষ্য করে সরকারের পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। এসময় ৩০ জন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী শহীদ হন। লালদীঘি ময়দানে ভাষণদানকালে তাকে লক্ষ্য করে দুবার গুলি বর্ষণ করা হয়। জনসভা শেষে ফেরার পথে আবারও তার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। বিএনপি সরকারের সময় ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না এই হামলার ঘটনা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাননি। নিজের প্রাণের মায়া উপেক্ষা করে জনগণের ভোট ও ভাতের অধিকার ফিরিয়ে আনতে এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে অটল থেকেছেন তিনি।
উল্লেখ্য যে, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ের সন্ত্রাসবিরোধী জনসভায় শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য এক ডজনেরও বেশি আর্জেস গ্রেনেড হামলা ও গুলি চালানো হয়। এই ঘটনায় নেতাকর্মীরা মানব-বর্ম রচনা করে প্রাণ রক্ষা করেন প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে সেই হামলায় নিহত হন ২২ জন, আহত হন শতাধিক মানুষ। আহত হন শেখ হাসিনা নিজেও। এছাড়াও ২০০০ সালের এক জনসভাকে কেন্দ্র করে শেখ হাসিনাকে হত্যার পরিকল্পনা করে উগ্রবাদীরা। বিএনপি-জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট জঙ্গিদের নেতৃত্বে গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হেলিপ্যাডে এবং জনসভাস্থলে ৭৬ কেজি ও ৮৪ কেজি ওজনের দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয়। ঘটনাস্থলে পৌঁছার পূর্বেই বোমাগুলো শনাক্ত হওয়ায় প্রাণে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
আজকের বাংলাদেশ ও শেখ হাসিনা
বিএনপি-জামায়াতের বর্বরতার পর, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ও প্রায় এক বছর গৃহবন্দি ছিলেন শেখ হাসিনা। তখন জেলে বসেই দিন বদলের সনদ রচনা করেন তিনি। জেল থেকে বের হওয়ার পর জাতির ভাগ্য বদলের ইশতেহার ঘোষণা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। ফলে ২০০৮ সালের নির্বাচনে একচেটিয়া জয় লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪ দলের জোট। জোটের মোট অর্জিত ২৬৭ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগই পায় ২৩০টি।
এরপর সুশাসন ও উন্নয়নের যে নজির স্থাপন করেন শেখ হাসিনা, তার ফলশ্রুতিতি পরবর্তীতে আরো দুইবার সরকার গঠনে সমর্থ হয় আওয়ামী লীগ। টানা সরকারে থাকার কারণে দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সেগুলো বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশকে গত এক যুগে পুরোপুরি বদলে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্য। আজকের বাংলাদেশ একযুগ আগে হয়তো কারো স্বপ্নে বা কল্পনাতেও উঁকি দেয়নি। কিন্তু সেটাই আজ বাস্তবে পরিণত হয়েছে শেখ হাসিনার দূরদর্শিতার কারণে। বাস্তবায়িত হয়েছে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধী, খুনি ও ধর্ষকদের বিচার; মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উন্নীত হয়েছে পাঁচ কোটি নিম্নবিত্তের মানুষ, বেড়েছে মাথাপিছু আয় ও জীবনযাত্রার মান, বিদ্যুতের আলোয় ঝলমল করছে দেশ। ফলে বাড়ছে শিক্ষার হার। কমে গেছে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদীদের লাগামহীন অপতৎপরতা।
দেশের স্থলভাগের প্রায় সমআয়তন জলসীমা জয়ের কারণে খুলে গেছে ভবিষ্যতের জন্য ব্লু-ইকোনোমির নতুন দুয়ার, বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনন্ত আকাশেও শুরু হয়েছে দৃপ্ত পদচারণা। শেখ হাসিনার কারণেই বাংলাদেশ আজ উন্নত বিশ্বের কাতারে নাম লেখানোর প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে পেরেছে। যদি শেখ হাসিনা সেদিন দেশে না ফিরতেন, তাহলে হয়তো উগ্রবাদের চেপে ধরা অন্ধকারে আজ ডুবে যেতাম আমরা। কিন্তু একটি প্রত্যাবর্তনেই বদলে গেছে সব। বিশ্বজুড়ে আজ বাংলা, বাঙালি ও বাংলাদেশের যে বিজয়কেতন; তার ভিত্তি পড়েছিল সেদিনই, যেদিন ছয় বছরের নির্বাসন শেষে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন শেখ হাসিনা। তাই এই দিনটি জাতির ইতিহাসের এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।